কক্সবাজার, রোববার, ৫ মে ২০২৪

ছাদে ড্রাগন ফল চাষে মঞ্জুরের সফলতা এবং সবুজ বিপ্লবের সম্ভাবনা

আমরা অনেকেই ছাদ বাগান সম্পর্কে অবগত। আবার অনেকেই ছাদ বাগানের সাথেও জড়িত। পাকা বাড়ির খালি ছাদে বেড তৈরি করে অথবা টব, বাস্কেট কিংবা ড্রামে চাষাবাদ করে যে বাগান গড়ে তোলা হয় সেটায় ছাদবাগান। ইটের তৈরি যেকোন আবাসিক, বাণিজ্যিক ভবন বা কলকারখানার ছাদে নান্দনিক বাগান গড়ে তোলা যায়।

দেশের বিভাগীয় শহরগুলো হরহামেশাই ছাদবাগান নজরে আসে। বর্তমানে জেলা এবং উপজেলা শহরেও পরিলক্ষিত হচ্ছে ছাদবাগান।

বিভাগীয় শহরগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে ছাদবাগানে তেমন একটা পিছিয়ে নেই কক্সবাজারবাসী। কক্সবাজার শহরের দালান- কোঠার ছাদে উঠলেই দেখা মিলে ফুলে-ফলে ও সবজিতে ভরা ছাদবাগানের।

পরিত্যক্ত ছাদে টপ, কাটা ড্রাম এবং বাস্কেটের সাহায্যে রকমারি ফলের সাথে ড্রাগন ফলের চাষ করে মাইলফলক সৃষ্টি করেছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে কর্মরত উপ-প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবুল মঞ্জুর ভাই। বছর তিনেক আগে রকমারি ফল ও সবজির পাশাপাশি ড্রাগন ফলের চাষ শুরু তিনি। বর্তমানে ড্রাগন চাষের প্রতিই তিনি বেশি ঝুঁকে পড়েছেন এবং অপরাপর ব্যক্তিদেরও পরিত্যক্ত ছাদে ড্রাগন ফল চাষে উৎসাহিত করে যাচ্ছেন।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের যে ছাদটি একসময় ছিল পরিত্যক্ত সেই ছাদটি এখন সবুজের সমারোহে মনোহরা ছাদবাগানে পরিণত।

সবুজ বিপ্লবের অগ্রদূত আবুল মঞ্জুর ভাই করোনা মহামারীর যাঁতাকলে আবদ্ধ মুহূর্তগুলো হেলায় না ফেলে নিরলস পরিশ্রমে তিলে তিলে জেলা প্রাশসক কার্যালয়ের পরিত্যক্ত ছাদে গড়ে তুলেছেন দৃষ্টিনন্দন বাগান। বছর তিনেক আগে রকমারি ফল ও সবজির পাশাপাশি ড্রাগন ফলের চারা লাগিয়ে সবুজ বিপ্লবের পথে অগ্রসর হন তিনি। বর্তমানে সেই বাগানে ড্রাগন গাছের সংখ্যা অর্ধ-সহস্রধিকেরও বেশি।

গাছগুলো সামান্য পরিচর্যাতেই বেড়ে উঠেছে। ফলনও হচ্ছে ভালো। প্রতিটির ড্রাগন ফলের ওজন আনুমানিক ৩শ থেকে ৪শ গ্রাম।

পরিত্যক্ত ছাদে ড্রগন ফল চাষের পদ্ধতি এবং এই ফলের গুণাগুণ সম্পর্কে আলাপ করতে গিয়ে আবুল মঞ্জুর ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারি- ছাদবাগানে ড্রাগন ফলের চাষ মাটির টব, বাস্কেট কিংবা ড্রামে করা যায়। তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি ২০ ইঞ্চি আকারের ড্রাম বেছে নেওয়া হয়। কারণ এই আকারের ড্রামে চারা ভালোভাবে শিকর ছড়াতে পারে আর তাতে ফলনও হয় অনেক বেশি। চেষ্ট করলে প্রায় সব রকমের মাটিতে ড্রাগন ফল চাষ করা সম্ভব।

ড্রাগন ফলের ক্ষুদ্র কালো বীজগুলো ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৯ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ। এগুলো হার্টের জন্য খুবই ভাল এবং কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ এর ঝুঁকি কমায়। তাই ড্রাগন ফল খাওয়া হার্টের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপকারি। এটি হার্ট ভাল রাখার পাশাপাশি রক্তচাপ ও ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

সুস্বাদু ও লোভনীয় এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ড্রাগন ফলটি মূলত ভিনদেশি হলেও এখন দেশেই চাষ হচ্ছে। ড্রাগন ফলের সুখ্যাতি এখন সব জায়গায়। খুব সহজেই বাড়ির আঙিনা বা ছাদে ফলটি চাষ করা যায়। ড্রাগন ফলের গাছ লতানো, মাংসল ও খাঁজকাটা। লোহা, কাঠ বা সিমেন্টের খুঁটি বেয়ে এটি বড় হতে পারে।

ড্রাগন ফলটি পিতায়য়া নামেও পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Hylocereus undatus. এটি একধরনের ফণীমনসা বা ক্যাক্‌টাস প্রজাতির ফল। গণচীন-এর লোকেরা এটিকে আগুনে ড্রাগন ফল এবং ড্রাগন মুক্তার ফল বলে। ভিয়েতনামে মিষ্টি ড্রাগন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতে ড্রাগন ফল এবং থাইল্যান্ডে ড্রাগন স্ফটিক নামে পরিচিত। অন্যান্য দেশে স্ট্রবেরি নাশপাতি বা নানেট্টিকা ফল নামেও পরিচিত। এই ফলটি একাধিক রঙের হয়ে থাকে। তবে লাল রঙের ড্রাগন ফল বেশি দেখা যায়।

ড্রাগন মূলত আমেরিকার একটি প্রসিদ্ধ ফল, যা বর্তমানে বাংলাদেশেও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। আমাদের দেশে ২০০৭ সালে প্রথম থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে এ ফলের বিভিন্ন জাত আনা হয়। নরম শাঁস ও মিষ্ট গন্ধযুক্ত গোলাপি বর্ণের এ ফল খেতে অনেক সুস্বাদু। তার সাথে ভিটামিন সি, মিনারেল পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ও ফাইবারের উৎকৃষ্ট উৎস। আমাদের দেশের আবহাওয়া ড্রাগন ফল চাষের জন্য উপযোগী। যে কেউ চাইলে সহজেই বাড়ির ছাদে বড় টব, কাটা ড্রাম ও বাস্কেটে ড্রাগন ফল চাষ করতে পারে।

কক্সবাজার শহরের বৃক্ষপ্রেমীদের সমন্বয়ে একটি ” গ্রীন রেভুলোশন সোসাইটি” গঠনের কাজ চলমান বলেও জানা যায় মঞ্জুর ভাইয়ের কাছ থেকে। এ সোসাইটির কাজ হবে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীদের অবসর সময়ে ছাদ বাগানে আত্মনিয়োগে উৎসাহ প্রদানের পাশাপাশি সরকারি- বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন আপন আপন ভবনের পরিত্যক্ত ছাদে ফুল-ফলফলাদি ও সবজি চাষের মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবের পথে বৃক্ষপ্রেমীদের শামিল করা।

সবুজ বিপ­বের সূচনা হয় ১৯৪৪ সালে মেক্সিকোতে। মূলত উচ্চ ফলনশীল গম জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে এ বিপ­বের যাত্রা শুরু। এর নেতৃত্ব দেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কৃষি বিজ্ঞানী ড. নরমোন ই বোরলগ।

মেক্সিকোর পর অনেক দেশেই সবুজ বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। আমাদের দেশও তেমন একটা পিছিয়ে নেই। আমরা যদি অবসর সময়টুকু কৃষি কাজে ব্যয় করি অথবা পরিত্যক্ত জায়গা এবং ছাদে রকমারি ফলফলাদি ও সবজির চাষে নিজেদের আত্মনিয়োগ করে নিজ এবং পারিবারিক চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেশকে সবুজ বিপ্লবের পথে অনেকটায় এগিয়ে নিতে পারি।

“পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি”- কথটি মাথায় রেখে আমরা যদি চেষ্টা করি তাহলে সহজেই ছাদবাগানে ফলবে লাউ, কুমড়া, টমেটো, শাক, শিমসহ নিত্যদিনের আহার্য সবজি। মিলবে গোলাপ, টগর, জুঁই, চামেলির ছড়ানো সৌরভ এবং আম, পেয়ারা, মাল্টা, জাম্বুরা, ড্রাগনসহ হরেক রকমের বিষমুক্ত ফল হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে ছাদের বাগানে।

যদি ব্যক্তি প্রচেষ্টার সাথে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার সংমিশ্রণ থাকে তাহলে ঘরে ঘরে গড়ে উঠা ছাদ বাগানের পরশে একদিন সবত্র প্রবাহিত হবে সবুজ বিপ্লবের হাওয়া।

মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ ফয়েজ,
প্রভাষক, ইতিহাস
কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজ।

পাঠকের মতামত: